শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৫ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম:
বিস্মিল্লাহির-রহ্মানির রহিম।
জনাব স্পীকার
আসসালামু আলাইকুম
একাদশ জাতীয় সংসদের ২০২১ সালের প্রথম অধিবেশনে ভাষণ প্রদানের এ সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়ায় আমি পরম করুণাময় আল্লাহ্র নিকট শোকরিয়া আদায় করছি। এ উপলক্ষ্যে আমি আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে মাননীয় সংসদ-সদস্যবৃন্দ ও প্রিয় দেশবাসীকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি
১.২। শুরুতেই আমি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অমর শহিদকে, যাঁদের অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি একটি সার্বভৌম দেশ ও স্বাধীন জাতিসত্তা, পবিত্র সংবিধান ও লাল-সবুজ পতাকা। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে যাঁরা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন
১.৩। আমি আরও স্মরণ করছি তাঁদেরকে, যাঁরা এ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের মর্যাদা সমুন্নত রাখার লড়াইয়ে আত্মত্যাগ করেছেন। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের তিন মহান পুরুষ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে যাঁদের অবদান আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে
১.৪। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকাণ্ড ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সেদিন শাহাদত বরণ করেছিলেন তাঁর সহধর্মিণী মহীয়সী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও পারভীন জামাল রোজী, ছোট ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি ও মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি এবং সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জামিল উদ্দিন আহমেদ। আমি তাঁদের সবাইকে অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মরণ করছি এবং পরম করুণাময় আল্লাহ্র কাছে তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি
১.৫। আমি গভীর দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করছি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের জনসভায় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে পরিচালিত গ্রেনেড হামলায় শাহাদত বরণকারী নারীনেত্রী আইভী রহমানসহ আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের। আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র কাছে তাঁদের সকলের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি
১.৬। গত বছর জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমরা হারিয়েছি তাঁদেরকেও আমি এখানে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ও বেগম সাহারা খাতুন, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে। এছাড়া হারিয়েছি সাবেক ডেপুটি স্পীকার শওকত আলী, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অবঃ) সি আর দত্ত, লেফটেনেন্ট কর্ণেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী, বিশিষ্ট আইনজীবী ও এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক এটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের অনেক ব্যক্তিত্বকে। আমি তাঁদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করছি
জনাব স্পীকার
১.৭। সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে চতুর্থবারের মতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ ও ‘রূপকল্প ২০৪১’ গ্রহণ করে। ৬ষ্ঠ ও ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সফলতার সাথে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট-এর লক্ষ্যমাত্রাসমূহ নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্জন করে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের শ্রেণিতে উত্তরণের সকল যোগ্যতা অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। ইতোমধ্যে সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়ন শেষে ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর কৌশলগত দলিল হিসাবে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ প্রণয়ন করেছে। প্রণয়ন করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২১-২০২৫ প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শন ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর প্রধান অভীষ্ট হলো ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের অবসান, উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশের মর্যাদায় উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবলুপ্তিসহ উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদায় আসীন হওয়া। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার এ লক্ষ্যসমূহ অর্জনে সম্পূর্ণভাবে সক্ষম হবে
জনাব স্পীকার
১.৮। দেশে আইনের শাসন সুসংহত ও সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারসহ চাঞ্চল্যকর অন্যান্য মামলার দ্রুত রায় প্রদান করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালীকরণ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি, জুয়া, মাদক, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে এবং জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে
জনাব স্পীকার
১.৯। বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনা ভাইরাস মানবসভ্যতাকে ইতিহাসের এক চরম বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। করোনার প্রভাবে গোটা বিশ্বের ন্যায় আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ অর্থনীতির সকল সেক্টরে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জীবনযাত্রায় নেমে আসে অচলাবস্থা। এ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনা এবং প্রতিনিয়ত ভার্চুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে নানামুখী দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সংবলিত ১ লক্ষ ২০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর ফলে রপ্তানি ক্ষেত্রে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ ও ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর ফলে মানুষ চরম হতাশার মাঝেও আশার আলো দেখেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সময়োচিত সাহসী সিদ্ধান্ত এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশ করোনা পরিস্থিতি সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় প্রথিতযশা সাময়িকী ‘ফোর্বস’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘8 (More) Leaders Facing The Coronavirus Crisis’ শীর্ষক নিবন্ধে উল্লিখিত সফল নারী নেত্রীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বলতর হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়, প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের জন্য আমি তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই
অর্থ বিভা
জনাব স্পীকার
২.১। গত এক দশকে গড়ে ৬.৬ শতাংশ ও পর পর তিনবছর ৭ শতাংশের উপর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির এ ধারাবাহিক অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। তবে, নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারী বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫.২৪ শতাংশে। তবে একই সময়ে মাথাপিছু জিডিপিতে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, এবং পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ৭.৭৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৭০ মার্কিন ডলার। একইসময়ে মাথাপিছু জাতীয় আয় ৮.১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলার
২.২। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও উৎকর্ষ সাধন এবং প্রাজ্ঞ রাজস্ব নীতি ও সহায়ক মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি সত্বেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি (১২ মাসের গড়) ছিল মাত্র ৫.৬৫ শতাংশ। বাজেট ঘাটতিও ধারণযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাময়িক হিসাবে বাজেট ঘাটতি ছিল জিডিপি’র ৫.৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে জিডিপি’র ৮.১ শতাংশে উন্নীত করা সত্বেও বাজেট ঘাটতি সীমিত রাখা সম্ভব হয়েছে। সরকারি ঋণ/জিডিপি অনুপাত মাত্র ৩৫.৭ শতাংশ। দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়টি উন্নয়ন সহযোগীসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলেও সমাদৃত হয়েছে। দ্যা ইকোনমিস্ট-এর ২ মে ২০২০ তারিখের গবেষণামূলক প্রতিবেদনে ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ৯ম স্থানে অবস্থান করছে। আইএমএফ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশী জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা শীর্ষদেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে
২.৩। ‘কোভিড-১৯’ বৈশ্বিক মহামারী সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নজিরবিহীন প্রভাব ফেলেছে। আইএমএফ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে বৈশ্বিক জিডিপি ৪.৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। কোভিড-১৯ এর এই বৈশ্বিক প্রভাব থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দীর্ঘ ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির কারণে কলকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সাময়িকভাবে স্থবিরতা দেখা দেয়। এ সংকট মোকাবিলা ও ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করে অর্থনীতির গতি পূর্বাবস্থায় আনার লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি একটি সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়, যা প্রণয়নে নিম্নের চারটি প্রধান কৌশলগত দিক বিবেচনা করা হয়: (ক) প্রথম কৌশল: সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি; কর্মসৃজনকে প্রাধান্য প্রদান এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নিরুৎসাহিতকরণ; (খ) দ্বিতীয় কৌশল: ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে কতিপয় ঋণ সুবিধা প্রবর্তন যাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত হয় এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুন্ন থাকে; (গ) তৃতীয় কৌশল: হতদরিদ্র ও সাময়িক কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত জনগণকে সুরক্ষা দিতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি; এবং (ঘ) চতুর্থ কৌশল: বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি
২.৪। এ কর্মপন্থার আওতায় সরকার পর্যায়ক্রমে সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সংবলিত ১ লক্ষ ২০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ঘোষিত এ প্রণোদনা প্যাকেজসমূহ জিডিপি’র ৪.৩ শতাংশ। এ প্যাকেজ বা কর্মসূচিসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কর্মসূচি হলো রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিক-কর্মচারির বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য বিশেষ তহবিল, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং মাইক্রো ও কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা প্রদান, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের সুবিধা বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বৃদ্ধি, লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণ, কৃষিখাতের জন্য বিভিন্ন সুবিধা প্রদান ইত্যাদি। আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস, ব্যাংকিং খাতে তারল্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে নীতি সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এ সকল সময়োপযোগী ও আকর্ষণীয় প্রণোদনা প্যাকেজসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ফলে দেশের অর্থনীতির গতিপ্রবাহ ঘুরে দাঁড়িয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে শুরু করেছে
২.৫। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশের স্বাস্থ্যখাতে যে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন উদ্ভূত হয়েছে তা মেটানো এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে অর্থ সঞ্চালনের দিকে লক্ষ্য রেখে স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়ন খাতসমূহকে অগ্রাধিকার দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার পূর্ববর্তী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৩.২৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দ পূর্ববর্তী অর্থবছরের সংশোধিত বরাদ্দ অপেক্ষা ৬.৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে ২ লক্ষ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা বিগত অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৮.৬ শতাংশ বেশি। কর ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পিত কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর এবং শুল্ক বিভাগকে আরো অটোমেটেড এবং ডিজিটাইজড করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অনলাইনভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর মূল্য সংযোজন কর পদ্ধতি প্রচলন করা হয়েছে। এ সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে
২.৬। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য বিরোধের কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অস্থিরতা এবং জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাসের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০২০ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাণিজ্যের গতি শ্লথ ছিল। পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে প্রধান রপ্তানি বাজারসমূহে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ে যার প্রভাব বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যেও পড়েছে। এর ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয়ে ১৬ দশমিক নয় তিন শতাংশে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং আয়ের পরিমাণ পূর্ববর্তী অর্থবছরের ৪০.৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলনায় হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩.৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। তবে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রপ্তানি আয় প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে এসেছে এবং প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২০) রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক পাঁচ আট শতাংশ। রপ্তানি খাতে বিভিন্ন প্রকার নগদ প্রণোদনাসহ ১ শতাংশ অতিরিক্ত প্রণোদনা চলতি অর্থবছরে অব্যাহত রাখা হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ড-এর আকার ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি করে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ ও এর সুদের হার ২ শতাংশে স্থির রাখা হয়েছে এবং প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম চালু করা হয়েছে। ২.৭। প্রবাসী বাংলাদেশীগণ কর্তৃক বৈধ পথে রেমিটেন্স প্রেরণে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা এবং রেমিটেন্স প্রেরণ পদ্ধতি সহজিকরণের সুফল হিসাবে প্রবাস আয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাস আয় পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ১০.৮৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮.২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। প্রধান শ্রমবাজারসমূহে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে প্রবাস আয় হ্রাসের সম্ভাবনা থাকলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২০) প্রবাস আয়ে প্রবৃদ্ধির হার ৪৫.৫৪ শতাংশ, যা অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক। আশা করা যায়, আগামী দিনগুলোতে প্রবাস আয়ে এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে। উল্লেখ্য, এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, দক্ষতা উন্নয়ন, নিরাপদ অভিবাসনসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে
২.৮। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধির ফলে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঘাটতি দূর হয়ে বর্তমানে ৩.২৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে। একইসাথে লেনদেনের সার্বিক ভারসাম্য উদ্বৃত্ত থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়ে অক্টোবর ২০২০ মাসে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ সময় মুদ্রা বিনিময় হার, বিশেষভাবে মার্কিন ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে
২.৯। সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে সমর্থন যোগানোর পাশাপাশি মূল্যস্তরসহ সামষ্টিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনই ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতির মূল উদ্দেশ্য। ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক চার শতাংশে সীমিত রেখে এবং ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মুদ্রানীতির কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি থেকে উদ্ভূত আর্থিক মন্দা মোকাবিলার লক্ষ্যে আর্থিক খাতে পর্যাপ্ত তারল্য নিশ্চিত করার জন্য নীতি সুদের হার ও নগদ জমা সংরক্ষণ আবশ্যকতার হার (CRR) একাধিকবার হ্রাস করা হয়েছে। বর্তমানে রেপো হার ও সিআরআর উভয়ই মাত্র ৪ শতাংশ। পুনরায় শিল্প, ব্যবসা ও সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে আর্থিক সক্ষমতা অর্জনসহ শিল্প ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ হার এক অংকে অর্থাৎ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে
২.১০। সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে নতুন বাজেট ও হিসাবরক্ষণ শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। নিজস্ব বিশেষজ্ঞদের দ্বারা তৈরি আইবাস++সফট্ওয়্যারের মাধ্যমে পূর্ত হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা হিসাবরক্ষণ কার্যালয় এবং রেলওয়েতেও সরকারের বাজেট প্রণয়ন ও হিসাব প্রক্রিয়াকরণ ২০১৯-২০ অর্থবছরে চালু করা হয়েছে। এ ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল করার লক্ষ্যে তাদের মধ্যে কনসলিডেশন এবং ইন্ট্রিগেশন কার্যক্রম নেয়া হবে। উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ছাড় প্রক্রিয়া সহজ করার লক্ষ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুমোদিত সরকারি প্রকল্পের অর্থ ব্যবহারের ক্ষমতা প্রকল্প পরিচালকদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এর ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ত্বরান্বিত হয়েছে
২.১১। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক খাতেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। ইতঃপূর্বে জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট (MDGs) এর ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যমাত্রাসমূহ বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়ন শেষে ‘রূপকল্প ২০৪১’ গ্রহণ করেছে, এবং এর কৌশলগত দলিল হিসাবে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) প্রণয়ন করেছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৫-২০) বাস্তবায়ন সফলতার সাথে শেষ হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২৫) প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সরকার ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী উন্নত দেশে উত্তরণের লক্ষ্য স্থির করেছে। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী মোকাবিলা, নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-এ বর্ণিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও লক্ষ্যসমূহ (SDGs) অর্জনে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের গৃহীত এ সকল কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে এবং দেশ অব্যাহত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভা
জনাব স্পীকার
৩.১। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ জোরদারকরণ, দেশজ শিল্পের প্রতিরক্ষণ এবং আয় বৈষম্য নিরসনের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার অভ্যন্তরীণ সম্পদ তথা রাজস্ব আহরণে সদা তৎপর এবং একটি সমন্বিত কর্ম-পরিকল্পনার মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। সরকারের Allocation of business অনুযায়ী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর সংগ্রহ, সঞ্চয়পত্র ও বণ্ড ব্যবস্থাপনা এবং স্ট্যাম্প ডিউটি ও বিবিধ ফি আদায় সংশ্লিষ্ট কার্যাবলি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের উপর ন্যস্ত
৩.২। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের প্রধান রাজস্ব আহরণকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, আবগারী শুল্ক, কাস্টমস ডিউটিসহ বিভিন্ন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায়ের মাধ্যমে দেশের মোট রাজস্বের প্রায় শতকরা ৮৬ ভাগের বেশি যোগান দিচ্ছে
৩.৩। জনমুখী ও ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর পরিবর্তে ০১ জুলাই ২০১৯ থেকে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ কার্যকর হয়েছে। ব্যবসার স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতির অগ্রগতি এবং আধুনিক Business Process-এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চাহিদা বিবেচনায় ও সর্বোপরি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে VAT Online Project এর আওতায় অনলাইনে নিবন্ধন গ্রহণ থেকে শুরু করে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল ও কর পরিশোধ এবং ই-পেমেন্ট সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একইসাথে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং এর আওতাধীন সকল ভ্যাট কমিশনারেটে Help desk এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে VAT Online Service Center স্থাপন করা হয়েছে। করদাতাগণ ১৬৫৫ নম্বরে ফোন করে ভ্যাট সংক্রান্ত যেকোন তথ্য সেবা গ্রহণ করতে পারেন। Electronic Cash Register/Point of Sale (ECR/POS) সফট্ওয়্যারের পরিবর্তে Electronic Fiscal Device/Sales Data Controller (EFD/SDC) স্থাপন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে EFD/SDC ব্যবহারকারীদের মধ্যে এ পর্যন্ত মোট ১ লক্ষ ৯৮ হাজার ৭৭টি e-BIN রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে এবং ৫ লক্ষ ৫৮ হাজার ৯১২টি ভ্যাট রিটার্ণ অনলাইনে দাখিল করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে EFD/SDC স্থাপন করা হবে
৩.৪। দেশীয় শিল্পের বিকাশ ও প্রসারের লক্ষ্যে বিদ্যমান ভ্যাট আইনে প্রদত্ত প্রণোদনা অব্যাহত রাখা হয়েছে। মোবাইল ফোন, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার ইত্যাদি শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে উপকরণ আমদানি ও উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহের ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে। এতে দেশে ভারী শিল্পের বিকাশ ঘটছে। তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য সিগারেটের মূল্য ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে
৩.৫। বর্তমান সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি সেবা বিকাশের লক্ষ্যে কম্পিউটার ও তার ইউনিটসমূহ, কম্পিউটার মডেম, সফট্ওয়্যার, রাউটার, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড ইত্যাদির উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি/হ্রাসকৃত হারের সুবিধা প্রদান করা হয়েছে
৩.৬। সরকারের লক্ষ্য সহজ ও নিরাপদ বাণিজ্য পরিবেশ তৈরি করে ব্যবসায়িক পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। শিল্পায়নে সহায়তাকল্পে সরকার মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে সর্বনিম্ন ১ শতাংশ শুল্ককর পরিশোধের সুবিধা প্রদান করেছে
৩.৭। শুল্কায়নে ২০১৪ সাল থেকে Automated System for Customs Data (ASYCUDA) প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত মোট ৫ বছরে ASYCUDA সিস্টেমের মাধ্যমে অনলাইনে ১ কোটি ৭৫ লক্ষ ৬৬ হাজার ১৪২টি Bill of Entry/Export প্রসেস করা হয়েছে এবং এ সিস্টেমের মাধ্যমে সর্বমোট ৪,১১,১৭১.৩৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ কাস্টমসের পুনর্গঠন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ‘বণ্ড অটোমেশন প্রকল্প’ চালু হলে রপ্তানিকারকদের বণ্ড সংশ্লিষ্ট যাবতীয় সুবিধা ডিজিটালি প্রদান করা সম্ভব হবে। বিমানবন্দরসমূহে এ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন (API) বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ কাস্টমস নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ যাত্রী চলাচল সুবিধা প্রদানে আরো বেশি সক্ষম হবে। অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (AEO) ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে বিশ্বস্ত ও নিরাপদ বাণিজ্য সহযোগীদের মালামাল বাধাহীনভাবে দ্রুততার সাথে খালাস প্রদান নিশ্চিত করা যাবে। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) বৈশ্বিক মহামারী মোকাবিলার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য-রক্ষার উপকরণ উৎপাদনে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ও তৈরি পণ্য (মাস্ক, পিপিই ইত্যাদি) আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করা হয়েছে
৩.৮। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অর্থনীতির মূল স্রোত গতিশীল করার লক্ষ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যক্তি ও কোম্পানি শ্রেণির করদাতাগণের করহার হ্রাস করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎসে আয়কর কর্তনের হার ২ শতাংশে হ্রাস করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আয়কর বিভাগের অটোমেশনের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে
৩.৯। জাতীয় রাজস্ব আহরণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য কেবল এর জনবলের কাঠামোগত সংস্কার নয় বরং বিশ্বায়নের যুগে অন্য দেশের কর ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কর পরিপালনের জন্য করসেবার বিভিন্ন কৌশলগত দিকের উন্নয়নসাধন করার বিষয় সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। কর পরিহার এবং কর ফাঁকি রোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সামগ্রিক জনবল, ভৌত অবকাঠামো, অটোমেশন, প্রশিক্ষণ এবং লজিস্টিকস এর উন্নয়নের মাধ্যমে করসেবা এবং কর এনফোর্সমেন্ট নিশ্চিত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে কর আহরণে একটি সক্রিয় ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে
৩.১০। অর্থ আইন, ২০১৬-এর মাধ্যমে ৩০ নভেম্বর কর দিবস (Tax Day) হিসাবে নির্ধারিত হওয়ার পর প্রতিবছর ৩০ নভেম্বর কর দিবস উদ্যাপিত হয়ে আসছে। বিরাজমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় বিবেচনা করে একইস্থানে অতিরিক্ত জনসমাগম পরিহারের লক্ষ্যে ২০২০ সালে র্যালি ব্যতীত জাতীয় আয়কর দিব
উদ্যাপন করা হয়েছে এবং আয়কর মেলা আয়োজনের পরিবর্তে দেশব্যাপী সকল কর অঞ্চলের কার্যালয়ে ৩০ নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে করদাতাগণের রিটার্ন গ্রহণ, টিআইএন প্রদান, কর তথ্য সেবা প্রদান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সর্বমোট অনলাইনে ৫৩ লক্ষ ৬২ হাজার ১৯৮টি ই-টিআইএন খোলা হয়েছে
৩.১১। প্রতিবছরের মত ২০২০ সালে সারাদেশের সেরা ১৪১ করদাতাকে ট্যাক্স কার্ড প্রদান করা হবে। এছাড়া, ৬৪টি জেলা ও ১১টি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৫২৫ জন করদাতাকে সম্মাননা প্রদান করা হবে
২.২৩। ইতোমধ্যে দেশের ৮টি বিভাগে রাজস্ব সম্ভাবনাময় ৩৭টি উপজেলায় আয়কর অফিস স্থাপন করা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে আরও ১০৩টি আয়কর অফিস স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে
৩.১২। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৯-২০ মেয়াদে রাজস্ব ৬২,০৪২.১৬ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২,১৮,৪০৮.৯৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বিগত দশ বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক আহরণকৃত রাজস্বের পরিমাণ প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে
৩.১৩। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণ দ্বারা জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মাধ্যমে আহরিত অর্থ জাতীয় বাজেট ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা; যা মোট বাজেটের ৩.৫২ শতাংশ এবং মোট ঘাটতি বাজেটের ১০.৭৫ শতাংশ
৩.১৪। ট্যাকসেস আপিলাত ট্রাইব্যুনালের করদাতা ও আয়কর বিভাগের মধ্যে আয়কর সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিপূর্বক সরকারের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা পালন করে থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ট্যাকসেস আপিলাত ট্রাইব্যুনালে ৬,৮০১টি কর মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮২১টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভা
জনাব স্পীকার
৪.১। আর্থিক নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে যথাযথ মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের মূল্যস্ফীতি পরিমিত পর্যায়ে সীমিত রেখে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকার আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছে। কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে প্রয়োজনীয় প্রাণসঞ্চার করার লক্ষ্যে এবং উৎপাদন সচল রাখতে বাংলাদেশ সরকার ১৩.২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে; যা জিডিপির শতকরা ৪.০৩ ভাগ
৪.২। সরকার কর্তৃক ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণার ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, একইসাথে অবৈধভাবে অর্থ পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২০ মেয়াদে আহরিত মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ৬.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বিগত অর্থবছরের আলোচ্য মেয়াদে আহরিত রেমিট্যান্স ৪.৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলনায় ৪৮.৫৪ শতাংশ বেশি। এছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে প্রায় ৪০.০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে
৪.৩। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত নানামূখী আর্থিক কর্মকাণ্ডের ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫.২ ভাগ অর্জন সম্ভব হয়েছে যা প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের তুলনায় অধিক। নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের আয় উৎসারী কর্মকান্ড সচল রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ বছর মেয়াদি ৩,০০০ কোটি টাকার আবর্তনশীল পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছে
৪.৪। কৃষি ও কৃষকবান্ধব সরকারি নীতিমালার সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি ও পল্লী অর্থায়নে বাস্তবমুখী একটি বার্ষিক নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। বর্তমানে তফসিলি ব্যাংকসমূহ কর্তৃক কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণে সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশে সীমিত রাখা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী খাতে সর্বমোট ২২ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ।